দিনাজপুর-১(বীরগঞ্জ-কাহারোল) সংসদীয় আসনে বিএনপি’র রাজনীতি অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি কিনা স্থানীয় রাজনীতি-সচেতন মহলে এ আলোচনা এখন ব্যাপক। স্বৈরাচার পরবর্তী গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার সময় থেকে এখন পর্যন্ত বীরগঞ্জ-কাহারোলের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির গতিপ্রকৃতির সঠিক এবং নির্মোহ বিশ্লেষনের মধ্যে দিয়ে এ বিষয়ে একটা উপসংহারে পৌঁছানো সম্ভব। কারন খুব স্পষ্টভাবে বললে নব্বই পুর্ববর্তী সময়ে এ অঞ্চলের জাতীয়তাবাদী রাজনীতি মূলত ছাত্র রাজনীতির মধ্যেই গন্ডিবদ্ধ ছিলো।
স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে দেশের অন্যান্য প্রান্তের মতো এ এলাকাতেও ছাত্রদলের সাহসী অংশগ্রহণ,তাদের নেতৃত্বের বলিষ্ঠ ভুমিকা এতটাই উজ্জ্বল ছিলো যে স্বাধীনতার পর থেকে আওয়ামী দূর্গ বলে খ্যাত দিনাজপুরের এ আসনটি আগামীদিনে আওয়ামী রাজনীতির নাগালের বাইরে চলে যাবে বলে একটা কমন পারসেপশন গড়ে উঠেছিলো। অথচ তেমনটি কিন্তু হয়নি। একানব্বই’র সাধারন নির্বাচনের ফলাফলই তার প্রমান দেয়। এর কারন খুঁজে বের করতে খুব জটিল সমীকরণ মেলানোর প্রয়োজন নেই। খুব সহজ কারন হচ্ছে বিএনপি রাজনীতির মুল ধারাটি তখনও এখানে ক্ষুরধার হয়ে ওঠেনি। সে বছর বিএনপি রাষ্ট্র শাসনের সুযোগ পেলেও বীরগঞ্জ-কাহারোলে দলটির শক্ত সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তুলতে সময় লেগে যায় আরও কয়েকটি বছর।
অত্র অঞ্চলে দুর্বল কাঠামোর এই রাজনৈতিক দলটির ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রাখেন একানব্বই সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসন থেকে নির্বাচিত সাংসদ খুরশিদ জাহান হক। অতীত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাহীন এ মানুষটি মুখ্যত তাঁর উন্নয়ন আকাঙ্খা এবং সেটার সফল বাস্তবায়ন প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়েই রাজনীতি নির্বিশেষে গণমানুষের মনে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিতে থাকেন। এবং এরই প্রভাবে পুরো জেলা জুড়ে অনেকটাই স্থবির বিএনপি রাজনীতিতে নবজাগরনের দোলা লাগতে শুরু করে। খুরশিদ জাহান হক ক্যারিশমেটিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন কিংবা যাদুর কাঠির ছোঁয়ায় তিনি দিনাজপুরের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির খোলনলচে পাল্টে দিয়েছিলেন-ব্যপারটা তেমন না। বেগম খালেদা জিয়া’র বড় বোন এই পরিচয়টাই বরং তাঁর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বিকাশে কাজে লেগেছিলো খুব কিংবা দক্ষতার সাথে তিনিই সেটাকে কাজে লাগিয়েছিলেন। সমগ্র জেলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কর্মীরা অবশেষে একজন অভিভাবক খুঁজে পেয়েছিলেন।
ছেয়ানব্বই নির্বাচনে দিনাজপুর সদর আসনে খুরশিদ জাহান হকের বিজয় ছিলো এ জেলায় বিএনপি’র ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে স্পষ্টতই একটা টার্নিং পয়েন্ট। যদিও দলটি সেবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায়নি কিন্তু দল গোছানোর ক্ষেত্রে এটা যেন একরকম শাপেবর হলো। ব্যাপক কর্মযজ্ঞের মধ্যে দিয়ে জেলার ছয়টি নির্বাচনী এলাকায় বিএনপি তাদের ভিত্তিটি তৈরী করে ফেলতে পেরেছিলো বেশ শক্তপোক্ত ভাবেই।
বীরগঞ্জ কাহারোলও পিছিয়ে থাকলো না। আটানব্বই’র মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই দু’উপজেলার মোট সতেরটি ইউনিয়নের মূলদল এবং অঙ্গসংগঠনগুলোর নির্বাচিত কমিটি তৈরী হয়ে গেল। এর অল্প সময়ের মধ্যেই সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হলো দুই উপজেলা কমিটি। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজটি হলো আগামী সাধারন নির্বাচনকে লক্ষ্য ধরে দু’উপজেলার শীর্ষনেতাদের মিলিত উদ্দোগে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন। উপজেলা দুটির সতেরটি ইউনিয়নের রাজনৈতিক কর্মকান্ড সমান তালে পরিচালনার জন্য সমন্বয় কমিটির অভূতপুর্ব সব উদ্দোগ ঝিমিয়ে পড়া কর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্যে সৃষ্টি করতে সমর্থ হলো। সত্যিকার অর্থেই জেগে উঠলো জাতীয়তাবাদী চেতনা। নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ এবং জাতীয়তাবাদের ঝান্ডা উড়ানোর স্বপ্নও প্রকৃত অর্থে ডালা মেলতে শুরু করলো তখন থেকেই। কিন্তু বিধাতা বোধহয় অলক্ষ্যে হেসেছিলেন সেদিন। কারন পরবর্তী অল্প দিনের মধ্যেই স্বপ্নের শুরু আর স্বপ্নের অপমৃত্যুর যুগপৎ চিত্রনাট্য লেখার কাজটিও শুরু হয়ে গিয়েছিলো।
দিনাজপুর এক আসনে বিএনপি রাজনীতির আনন্দ বেদনার সময়কালটা একই। সেটা দু’হাজার এক’র সাধারন নির্বাচনের সময়। একটা লম্বা সময় ধরে সংগঠন সংগঠিত করার শ্রমসাধ্য আয়োজন শেষে ফল প্রাপ্তির কাছাকাছি সময়ে এসে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় পুড়তে হলো বিএনপি’কে। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে চারদলীয় ঐক্যজোটের শরীক জামায়াতে ইসলাম কে ছেড়ে দিতে হলো আসনটি।
বিএনপি রাজনীতির দুর্ভাগ্যের শুরুও হলো সেদিন।
জাতীয়তাবাদের সাজানো বাগান তার সব সৌন্দর্যসহ তুলে দিতে হলো জামায়াতের হাতে। আওয়ামী দূর্গ তছনছ করে দিয়ে জামায়াত জিতে গেল নির্বাচন। একানব্বই আর ছেয়ানব্বই নির্বাচনে বিশ হাজারের নিচে ভোট পাওয়া জামাত প্রার্থী সাংসদ হলেন প্রায় নব্বই হাজার ভোট পেয়ে। নৌকার সাথে যেটার বিস্ময়কর ব্যবধান-প্রায় সাতাশ হাজার। স্হানীয় বিএনপি’র জরীপে জামায়াত প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের ষাট শতাংশ তাদের।
দু’হাজার এক থেকে ছয়, শত বঞ্চনার মুখোমুখি হলেও দলের ঐক্য ধরে রেখে বিএনপি কর্মীরা তবুও আশায় বুক বাঁধেন। অপেক্ষায় থাকেন তারা পরবর্তী নির্বাচনের। সময় গড়ায় দু’হাজার সাত-আট’র বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার অসভ্য প্রচেষ্ঠার ক্রান্তিকালের মধ্যে দিয়ে। তবুও একাট্টা বিএনপি। ভালো সময় আসবেই। কিন্তু দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবার সেই জামায়াত। হতাশায় আক্রান্ত হতে থাকে নেতা আর কর্মীরা। রাজনীতির গতিশীলতায় আসে একধরনের স্হবিরতা। এই স্হবিরতা এক ধরনের সুযোগ তৈরী করে দেয় জামায়াতে ইসলামীর জন্য। আওয়ামী বিরোধী ভোটের বড় অংশটার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ গড়ে তুলতে থাকে তারা। ইসলামী মূল্যবোধের একমাত্র পাহারাদার হিসেবে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে নিজেদেরকে তারা অত্যন্ত সফলতার সাথে জাহির করতে সমর্থ হয়। একদিকে বিএনপি’র আশাহত কর্মীবাহিনী আর লক্ষ্যহীন নেতৃত্ব অন্যদিকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধর্মীয় তালিমের নামে জামায়াতের রাজনৈতিক তালিম বিএনপি’র ভোটের তহবিলকে ক্রমাগত ক্ষুদ্র করে দিতে থাকে। দু’হাজার এগারো আর ষোল’র পৌর নির্বাচন কিংবা সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচনের ফলাফলই প্রমান করে দেয় বিএনপি’র ভোটের অংকে বড় ধরনের গোলমাল হয়ে গেছে। যদিও কাহারোল উপজেলা নির্বাচনে জয়ী হন বিএনপি প্রার্থী কিন্তু সেটাও ভাইস চেয়ারম্যানের দু’টি পদ জামায়াতকে ছেড়ে দেয়ার শর্তে।
বীরগঞ্জ কাহারোল বিএনপিতে এখন আর নেতৃত্বের সুস্হ প্রতিযোগীতা নেই। অঙ্গসংগঠনগুলোর পুর্ণাঙ্গ কমিটি হচ্ছেনা বছরের পর বছর। তৃণমুল কর্মীরা মামলা আর গ্রেফতার আতংকে জেরবার। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে উজ্জীবনী শ্লোগান তুলে দৃপ্ত সাহসে হাতে হাত মিলিয়ে চলবার মত নেতৃত্ব নেই। সময়োপযোগী কৌশল নির্ধারনের মধ্যে দিয়ে সাংগঠনিক গতিশীলতা বজায় রাখবার দায়িত্ব নেয়ার মত দায়বদ্ধ জাতীয়তাবাদী মানুষ নেই। ভবিষ্যত কর্ম পরিকল্পনা নির্ধারন করে সুদুরপ্রসারি লক্ষ্য অর্জন করার আকাঙ্খা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মত সাহসী তারুণ্য নেই, দুরদর্শী যুববাহিনী নেই।
এতোগুলো নেই’র মধ্যেও মিটমিট করে জ্বলতে থাকা একটা স্বপ্ন এখনও বেঁচে আছে-দু’হাজার আঠারোর জাতীয় সংসদ নির্বাচন। টানেলের একেবারে শেষ প্রান্তে অনুজ্জ্বল আভা ছড়াচ্ছে সে স্বপ্ন। যদি সে স্বপ্ন আবার ভেঙ্গে যায়, যদি একজন সাচ্চা জাতীয়তাবাদীর হাতে এবারও না ওঠে ‘ধানের শীষ’ তবে বীরগঞ্জ-কাহারোলের বিএনপি রাজনীতির গল্প বোধহয় ইতিহাসেরই অংশ হয়ে যাবে।
সুবাস দাস
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব
যোগাযোগঃ [email protected]
Facebook Comments