বীরগঞ্জ নিউজ ২৪ ডেস্কঃ
ডালপালা কাটার পর এবার পালা মাদকের গডফাদারদের। এই গডফাদারদের তালিকায় রয়েছে অন্তত ১৭১ জন মাদক ব্যবসায়ী। যাদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের নেতাসহ তাদের ভাই ও সন্তানদের নাম রয়েছে। এরাই মূলত সারাদেশ নিয়ন্ত্রণ করে মাদক ব্যবসা করছে।
ইতিমধ্যেই তালিকা ধরে গডফাদারদের ধরতে মাঠে নেমছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গডফাদারদের খোঁজে শুক্রবার র্যা ব তছনছ করেছে রাজধানীর সবচেয়ে বড় মাদকের পাইকারি বাজার মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প, পুলিশ ব্লক রেইড দিয়েছে কমলাপুর রেলস্টেশন এলাকায়।
গতকালও ব্লক রেইড হয়েছে হাজারীবাগ ও তেজগাঁও রেললাইন-সংলগ্ন বস্তিতে। রবিবার ভোর পর্যন্ত (২৪ ঘণ্টায়) সারা দেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে নিহত হয়েছেন টেকনাফ পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি একরামুল হকসহ ১১ জন মাদক ব্যবসায়ী।
খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, মাদকের বিরুদ্ধে ‘অল আউট’ যুদ্ধ চলছে। ‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ নামের অভিযানে গতকাল পর্যন্ত ৮৬ জন মাদক ব্যবসায়ী র্যা ব-পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, মন্ত্রণালয়ে জমা হয়েছে এমন ছয়টি সংস্থার পৃথক তালিকা অনুযায়ী সব মিলিয়ে মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা ১৪ হাজার। ওই তালিকা থেকে ৫০০ ব্যবসায়ীর তালিকা করেছে মন্ত্রণালয়। সমন্বিত এই তালিকা নিয়ে কাজ শুরু করেছে র্যা ব ও পুলিশ। এ তালিকায় অন্তত ১৭১ জন রয়েছেন মাদকের গডফাদার। এরাই সারা দেশে নিয়ন্ত্রণ এবং পৃষ্ঠপোষকতায় চালাচ্ছে মাদক ব্যবসা। এদের মধ্যে রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা, তাদের ভাই ও সন্তানদের নাম। ৪ মে থেকে র্যা ব এবং ১৮ মে থেকে মাদকের বিরুদ্ধে ক্র্যাশ প্রোগ্রামে বিভিন্ন পর্যায়ের মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার হলেও গডফাদাররা অধরা থেকে যাওয়ায় নানা প্রশ্ন ওঠে। তবে গত তিন দিনে কক্সবাজারের এমপি আবদুর রহমান বদির বেয়াই আকতার কামাল এবং টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি একরাম র্যা বের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, শিগগিরই শুরু হচ্ছে গডফাদারদের বিরুদ্ধে অভিযান। শুরুতে নিচের দিকের ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান হওয়ায় গডফাদারদের ডালপালা কেটে যাচ্ছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি সংস্থার তদন্তে যেসব ‘গডফাদার’ বা পৃষ্ঠপোষকের নাম এসেছে, তাদের আইনের আওতায় আনা না গেলে মাদকের মূলোৎপাটন সম্ভব নয়। পাশাপাশি সীমান্তের যেসব পয়েন্ট দিয়ে মাদক ঢুকছে তা বন্ধ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। একই সঙ্গে মাদক সিন্ডিকেটে থাকা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এর সঙ্গে দেশের সব কটি বিমান, স্থল ও সমুদ্রবন্দরে মাদক ব্যবসায়ীদের ছবিসহ তালিকা দিয়ে তাদের আইনের আওতায় নেওয়ার ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
একাধিক সূত্র বলছে, চট্টগ্রাম বিভাগের ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী এক নেতার ছেলে নদীতে ড্রেজার জাহাজে ইয়াবা তৈরির মেশিন বসিয়েছেন। কাঁচামাল দিয়ে ইয়াবা তৈরি করে নদীপথেই ইয়াবা সরবরাহ করার বিষয়টি সরকারের উচ্চপর্যায়ে অবহিত করেছে একটি সংস্থা। এ বিষয়টিও অবহিত করা হয়েছে, ঢাকা বিভাগের একটি জেলায় নদীপথে ট্রলারে এবং বালুবাহী লাইটারে (ছোট জাহাজ) করে আনা ইয়াবা আনলোড করার ব্যাপারে সব ধরনের ব্যবস্থা করছেন তরুণ এক প্রভাবশালী নেতা। পাবনা জেলার ক্ষমতাসীন এক নেতার জনপ্রতিনিধি ভাই, সীমান্তবর্তী জয়পুরহাট জেলার এক প্রভাবশালী নেতার মাদকে প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা এবং লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে কুয়েত প্রবাসী এক নেতার মাদকের পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টি সম্পর্কে জানানো হয়েছে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষকে।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত তালিকায় কথিত গডফাদারদের নাম আছে কিনা তা আমার জানা নেই। যদি থেকে থাকে তাহলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা তাদের গ্রেফতারে অভিযানের জন্য নির্দেশিত হবেন। তখন ওই অভিযানের ওপর মানুষের আস্থা আরও বাড়বে।’
মাদকের বিরুদ্ধে একাধিকবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী গতকাল বলেন, ‘মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যই আমার বক্তব্য। ‘‘অল আউট যুদ্ধ’’ চলছে। মাদকের করাল গ্রাস থেকে দেশকে রক্ষা করতে আমাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’
জানা গেছে, মাদকের বিস্তার রোধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৫০০ জনের হিটলিস্টে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের নামও রয়েছে। শুরুতে ৫০০ জনের একটি প্রাথমিক তালিকা প্রস্তুত করেই তা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার আবদুল বাতেন বলেন, ‘মাদক নামের ভয়ঙ্কর অপরাধের সঙ্গে জড়িত সবাইকেই আমরা খুঁজছি। পর্যায়ক্রমে সবাইকেই আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। কারও রেহাই পাওয়ার সুযোগ নেই।’ র্যা ব সূত্র বলছে, সদর দফতরের নির্দেশনায় শুরুতে প্রতিটি ব্যাটালিয়নকে টপ ফাইভ মাদক ব্যবসায়ীর লিস্ট পাঠাতে বলা হয়। সে অনুসারে ১৪টি ব্যাটালিয়ন থেকে আসে ৭০ জন মাদক ব্যবসায়ীর নাম। পরবর্তী সময়ে প্রতি ব্যাটালিয়নের প্রতিটি কোম্পানিকে আলাদা করে ‘টপ ফাইভ’ মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা করে পাঠাতে বলা হয়। সে অনুসারে মাদক ব্যবসায়ীর তালিকার আকার গিয়ে দাঁড়ায় ২৮০ জনে। এ তালিকার প্রত্যেকের ইতিহাস পর্যালোচনা করে শীর্ষ ২০০ ব্যবসায়ীর একটি তালিকা তৈরি করে র্যা ব সদর দফতর। তালিকার বেশির ভাগ ব্যবসায়ীর নামেই রয়েছে কমপক্ষে তিনটি থেকে সর্বোচ্চ ১৫টি মামলা। তবে ২৮০ জনের তালিকায় অনেক প্রভাবশালীর নামে মাদকের মামলা না থাকলেও তাদের ‘হোয়াইট কালার ক্রিমিনাল’ হিসেবে বিশেষভাবে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। তাদের গতিবিধির ওপর বিশেষ নজর রাখতে নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে র্যা ব সদর দফতর থেকে।
বিজিবির অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মজিবুর রহমান বলেন, ‘বিশেষ অভিযানের এক মাস আগে থেকেই আমরা সীমান্তে মিয়ানমারের বিজিপির সঙ্গে বিশেষ অভিযান চালাচ্ছি। ওই অভিযানে অনেক সফলতাও এসেছে। বর্তমানে র্যা ব-পুলিশ সফলতার সঙ্গে অভিযান পরিচালনা করছে। তবে দেশের অভ্যন্তরে মন্ত্রণালয় যদি আমাদের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন তাহলে বিজিবি সদস্যরাও মাঠে নামবে।’
র্যা বের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ‘যারা প্রকৃত অপরাধী তাদের বিরুদ্ধেই আমাদের অভিযান। ১৪ মে থেকে র্যা ব মহাপরিচালক মাদকের ব্যাপারে গণমাধ্যমের সামনে একাধিকবার কথা বলেছেন। বার্তা দিয়েছেন মাদক ব্যবসায়ীদের। মাদক নির্মূলে র্যা বের প্রতিটি সদস্য তাদের সর্বোচ্চটা উজাড় করে দিচ্ছেন।’ ৪ মে থেকে মাদকবিরোধী ক্র্যাশ প্রোগ্রাম শুরু হলেও এর তীব্রতা পায় ১৫ মে থেকে। পুলিশের অভিযান শুরু হয় ১৮ মে থেকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে গত ১৩ দিনে এরই মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ৮৬ জন মাদক ব্যবসায়ী। গতকাল ভোর পর্যন্ত ১১ জন নিহত হয়েছেন বন্দুকযুদ্ধে।
এর মধ্যে টেকনাফের কাউন্সিলর একরামুল হক র্যা বের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। নিহত এসব ব্যক্তির প্রায় সবার নামেই একাধিক মাদক মামলা রয়েছে। ৪ মে থেকে র্যা বের ভ্রাম্যমাণ আদালত তিন হাজার ১৪৭ জন মাদক ব্যবসায়ীকে জেল-জরিমানা করেছে।
Facebook Comments